জন সংলাপ ডেস্ক:
ঢাকা থেকে এক যুবতীর লাশ এনে নোয়াখালীর চাটখিলে দাফনের ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। গভীর রাতে প্রাইভেটকারের ভেতরে আনা হয় লাশটি। মঙ্গলবার (৮ এপ্রিল) সকালে উপজেলার উত্তর রামনারায়ণপুর এলাকার মাইজের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে মেয়েটিকে দাফন করা হয়।
এই ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোষ্ট করেছেন অনেকে। রহস্যময় বিষয়টি নোয়াখালী জুড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে এটিকে হত্যাকান্ডের ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা বলে মনে করছেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, চাটখিল উপজেলার উত্তর রামনারায়ণপুরের মৃত ডাক্তার নুরুল হক চৌধুরীর ছেলে মাহাবুব হক চৌধুরী বাবর। ঢাকা ও চট্টগ্রামে তার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। নিহত ওই যুবতী মাহাবুব হক চৌধুরী বাবরের ঢাকার বাসায় কাজ করতেন বলে লোকমুখে জানা গেছে।
সোমবার(৭ এপ্রিল) বিকালে মেয়েটি মারা গেলে ঢাকা থেকে গভীর রাতে লাশ প্রাইভেটকারে করে উত্তর রামনারায়ণপুর এলাকার মাইজের বাড়িতে আনা হয়। পরে গোসল, জানাজা শেষে সকালে মাইজের বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। তবে কি কারণে বা কিভাবে মেয়েটি মারা গেছে তার কারণ জানাতে পারেনি এলাকাবাসী।
রাম নারায়ণপুরের আব্দুল মালেক জানান, তিনি মাহবুবুল হক চৌধুরী বাবরের মামাতো ভাই। খুব ভোরে প্রাইভেটকারে করে মেয়েটির লাশ এখানে আনা হয়। যার লাশ দাফন করা হয়েছে সেই মেয়েটি বাবরের ঢাকার বাড়িতে গত তিন বছর থেকে গৃহপরিচারিকার কাজ করতো বলে তিনি জেনেছেন।
মাহাবুবুল হক চৌধুরীর চাটখিলের বাড়ির কেয়ারটেকারের দায়িত্বে রয়েছেন আব্দুল আলী। তিনি জানান, রাত পৌনে বারোটার সময় বাবর সাহেব তাকে মোবাইলে কল দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন ঢাকা বাসার গৃহকর্মী মেয়েটি মারা গেছে। মেয়েটি তার দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। এজন্য লাশটি বাবর সাহেব নিজের পৈত্রিক কবরস্থানে দাফন করবেন। এর পর ভোর রাতে গাড়িতে করে বাবর সাহেবের মা জাহানারা বেগম, ছোট বোনের জামাই মানিক মিয়া ও তার স্ত্রী লাশ নিয়ে বাড়িতে আসেন। কিভাবে মেয়েটি মারা গেছে তা তিনি শোনেনি। তবে কবর খোঁড়া ও জানাযায় অংশ নিয়েছিলেন।
রামনারায়ণপুরের আলেয়া বেগম সম্পর্কে চৌধুরী বাবরের মামাতো ভায়ের স্ত্রী। তিনি ওই যুবতীর লাশ গোছলের কাজে সহায়তা করেছিলেন। কিভাবে মেয়েটি মারা গেছে এমন প্রশ্নে জানান, তার ভাবি( বাবরের স্ত্রী) জানিয়েছেন, মেয়েটি তাদের বাড়িতে কাজ করতো। সোমবার তাকে রান্নাঘরের কাজ বুঝিয়ে দিয়ে ভাবি বাজারে চলে যান। পরে বাসার ফিরে মেয়েটিকে রান্নাঘরের মেঝেতে মৃত পড়ে থাকতে দেখেন।
বেবি আক্তার রামনারায়ণপুর ও আশপাশ গ্রামের শতশত নারীকে শেষ গোছল দিয়েছেন। আলোচিত এই গৃহকর্মীর লাশটিও তিনি গোসল করিয়েছেন। সকাল ছয়টার সময় মাইজের বাড়িতে যান তিনি। গোসল করানোর সময় মেয়েটির শরীর নরম ও স্বাভাবিক ছিলো। মেয়েটিকে এখানে নিয়ে আসার কিছু সময় পূর্বেই মেয়েছি মারা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি। মৃত্যুর কারন তিনি জানতে পেরেছেন কি না এমন প্রশ্নে বলেন- “লাশ গোসলের সময় জাহানারা বেগম (বাবরের মা) বলেছেন, মেয়েটির মৃগী রোগ ছিল। রান্নাঘরে কাজ করার সময় হবেনে ইলেকট্রিক শকের কারণে সে মারা গেছে।” তবে মরদেহে বৈদ্যুতিক শকে পুড়ে যাওয়া কিংবা কোন ক্ষতের চিহ্ন দেখেননি বলে যুক্ত করেন বেবি আক্তার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাহবুবুল হক চৌধুরী বাবর বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভ্যাসেলস ইমপোর্টার্স এন্ড ডিলার্স এসোসিয়েশন (বিএআরভিডা) এর ট্যাক্স, ট্যারিফ, ভ্যাট ও পলিসি বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং দি ফেডারেশন অফ বাংলাদেশ চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি(এফবিসিসিআই) এর সদস্য। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হিসেবেও দেশের বাইরে ভ্রমণ করেছেন তিনি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে মাহাবুবুল হকের বিভিন্ন ব্যবসা রয়েছে। বছরে দু’একবার গ্রামের বাড়িতে আসেন। গত মঙ্গলবার ভোররাতে তার বাসার গৃহকর্মীর লাশ নিজস্ব গাড়ির পেছনের ডিকিতে করে চাটখিলে আনা হয়। সে সময় গাড়িতে মাহবুবুল হক চৌধুরী বাবরের মা জাহানারা বেগম, ছোট বোনের জামাই মানিক মিয়া ও তার স্ত্রী ছিলেন। ১৩/১৪ বছর বয়সী ওই গৃহকর্মীর নাম মার্জিয়া আক্তার। খুব ভোরে গোসল শেষ করা হয়। প্রাচীর ঘেরা বাড়ির উঠানে অল্পসংখ্যক লোক নিয়ে জানাজা সম্পন্ন করা হয়। পরে পৌত্রিক কবরস্থানে মেয়েটিকে সমাহিত করা হয়। মাটি দেওয়া শেষ হতেই চাটখিল ছাড়েন মাহবুবুল হক চৌধুরী পরিবারের সদস্যরা।
এবিষয়ে মুঠোফোনে কথা হলে মাহবুবুল হক চৌধুরী বাবর বলেন, গৃহকর্মী ওই মেয়েটির বাবা-মা কেউ নেই। দীর্ঘদিন থেকে মেয়েটি তাদের বাড়িতে কাজ করছে। মেয়েটির মৃগীরোগ ছিলো। সোমবার(৭ এপ্রিল) দুপুরের খাবার শেষে নিজের রুমে বিশ্রাম নিতে যায়। বিকাল শেষে ঘুম থেকে উঠছেনা দেখে রুমে গিয়ে ডাকলে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। পরিবারের সদস্য বিবেচনা করে মেয়েটিকে নিজের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে বলে জানান মাহাবুবুল হক। মেয়েটিকে কোন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো কিনা এমন প্রশ্নে জানান, মেয়েটি বিকালে ঘরের ভেতরে মৃত অবস্থাতেই পাওয়া যায়। মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত থাকায় তাকে আর হাসপাতালে নেওয়া হয়নি।
মেয়োটির লাশ ঢাকা থেকে পরিবহন করে চাটখিলে আনা হবে এই বিষয়টি স্থানীয় থানা পুলিশ ও চাটখিল থানাকে অবগত করা হয়েছিলো কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “আমার বাবার লাশ ঢাকা থেকে চাটখিলে নিয়ে কবর দেওয়া হয়েছে সেসময় তো থানা পুলিশকে জানানোর প্রয়োজন হয়নি। মেয়েটিকে আমি নিজের পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে দেখি। এজন্য প্রশাসনকে বিষয়টি জানানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনাই।” এছাড়া লাশটি এম্বুল্যান্সে করে নিয়ে আসার কথা বলেছেন মাহাবুবুল হক। তবে এলাকার কেউ এম্বুল্যান্সটি দেখেনি বলে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে।
এবিষয়ে চাটখিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ ফিরোজ উদ্দীন চৌধুরী বলেন, চাটখিলের উত্তর রামনারায়ণপুরে ঢাকা থেকে আনা গৃহকর্মীর লাশ দাফনের বিষয়ে অফিসিয়ালি তিনি কিছুই জানেন না। তবে লোকমুখে এমন ঘটনার বিষয়ে তিনি শুনেছন।
মাহাবুবুল হকের পরিবার নিহত মেয়েটিকে তাদের বাড়ির কাজের মেয়ে বলে প্রচার করেছেন গ্রামবাসীর কাছে। তবে মেয়েটি আদৌও গৃহকর্মী কি না তার প্রমান মেলেনি। তাছাড়া ঢাকা থেকে আনা লাশ চাটখিলে দাফনের বিষয়ে নানা রহস্যের জন্ম দিচ্ছে জনমনে।